ব্যাক্তিগতভাবে আমার কোনো গাড়ি নাই। আমার বাবারও নাই। আমার দাদারও ছিল না। অতএব বংশপরস্পরায় আমরা অন্যের জিপ, বাস, সিএনজি বা রিকশাতেই চলে আসছি অাজীবন।
ছোটবেলায় থাকতে অন্য সবার মত আমার মনেও 'সুপারহিরো' ভাবটা কাজ করত। ক্লাশের রোল থেকে শুরু করে গাড়িতে উঠলে রোড়ে পর্যন্ত আমার আগে কেউ যাবে এটা আমি সহ্য করতে পারি না। আমি যখন একলা রাস্তায় চলতাম আমার সামনের লোকটা যত দুরেই হোক, আমি হাঁটার স্পিড বাড়িয়ে তাকে ছাড়িয়ে যেতাম। আব্বার সাথে বেরোলে আমি আব্বাকে ছাড়িয়ে এগিয়ে যেতাম অনেকদুর। আমি এগুলোকে এক এক সফলতা মনে করতাম। গুণতাম এগুলো, কোন দিন সর্বমোট কতটি সফলতার কাজ করতে পেরেছি। এজন্যই বোধহয় একটা ছেলে ষষ্ঠ শেণীতে ৫১ নাম্বারে ভর্তি হয়েও ২-১ বছরের মাথায় দু'তিনশ ছেলের মাঝে প্রথম স্থানটাকে নিজের পাকাপাকি করে নিয়েছিল।
খুব ছোটবেলায় আমাদের এলাকায় একবার মন্ত্রী সালাউদ্দিন আহমেদ এসেছিলেন। তিনি হেঁটে হেঁটে সবার অবস্থা দেখছেন আর কিছু জিজ্ঞাসা করছেন। লোকজন পিছন থেকে তার কথার জবাব দিচ্ছিলেন। তিনি খুব জোরপায়ে হাঁটছিলেন। আমি বারবার পেছনে পড়েও দৌঁড়ে গিয়ে তার আগে চলে আসছিলাম, যা দেখে বড় বড় লোকগুলার অনেকেই আমার দিকে চোখ রাঙ্গাচ্ছিল, অনেকে চোখের ইশারায় বারণ করছিল বারবার। কিন্তু আমি তো অন্য ধাতুতে গড়া।
ছোটবেলায় ছোট রিকশা জিপে উঠার চেয়ে বড় বাসগুলোকেই প্রিপার করতাম বেশি। বাসে উঠে আব্বুকে সিটে বসিয়ে রেখে আমি ড্রাইভারের পাশের উঁচু অংশে গিয়ে উঠে হাত-পা তুলে গোল করে বসে থাকতাম। সেখানে বসে আমি বুঝেছিলাম প্রতিযোগিতা কি জিনিস! একটা বাস আরেকটা বাসকে অতিক্রম করে যাওয়াটাকে আমার পৃথিবীর সবচেয়ে মধুরতর প্রতিযোগিতা মনে হতো! আমি মন প্রাণ ভরে উপভোগ করতাম। আমাদের বাসটা অন্যকোনো বাসকে অতিক্রম করতে পারলে আমি খুশিতে তালি দিয়ে উঠতাম। আমি প্রবলভাবে বিশ্বাস করতাম, এগিয়ে যেতে হলে ওভারটেক করতে হয়, সামনের জনকে পেছনে ফেলতে হয়। নাহয় এগিয়ে যাওয়ার আনন্দটা ঠিক উপলব্ধি করা যায় না। নাহয় আমি যে এগোচ্ছি সেটা বুঝব কি করে!
একবার মার প্রচন্ড অসুখ বেঁধেছিল। বাবা বাড়ি ছিলেন না। আমি মাকে নিয়ে চকরিয়া যাব। বাসে উঠে মাকে আমার ছোট বোনটার পাশে বসিয়ে যথারীতি ড্রাইভারের পাশের উঁচু অংশে গিয়ে বসলাম। দেখলাম ড্রাইভার আমার পাশের বাড়ির বাদশা আংকেল! তিনি মার কি হয়েছে জানতে চাইলেন। আমি বুঝিয়ে বললাম- আংকেল, এখন এগারোটা পঁচিশ বাজে। আমার মাকে বারোটার আগে ডাক্তার দেখাতে হবে। বারটার পর ডাক্তার থাকেন না। তখন কষ্টে পড়ে যাব। বাড়িতে আব্বাও নাই।
আংকেল বলে, নো টেনশন! ভালো করে ধরে বসো। তারপর সে কি টান! এক এক করে সব গাড়িকে পেছনে ফেলতে লাগল। আমার শত টেনশনের মাঝেও এক ধরণের আনন্দ লাগছিল। ডাক্তার ধরতে পারার আনন্দ।
আংকেল বলে, নো টেনশন! ভালো করে ধরে বসো। তারপর সে কি টান! এক এক করে সব গাড়িকে পেছনে ফেলতে লাগল। আমার শত টেনশনের মাঝেও এক ধরণের আনন্দ লাগছিল। ডাক্তার ধরতে পারার আনন্দ।
ভয়ংকর গতিতে গাড়ি চালাতো বাদশা আংকেল। আমাদের বারোটায় পৌঁছাতে গিয়ে, অন্য যাত্রীদের বারোটা আগেই বেজে যাচ্ছিল। তারা গালাগালি করছিল। আংকেল আমার দিকে তাকিয়ে হাসছিল।
সে তার মাথার উপরের গ্লাস ঘুরিয়ে দিল, যাতে পেছনে থাকা যাত্রীরা তাকে না দেখতে পায়।
আংকেলের মতে, চেহারা না দেখে গালি দিলে মজা না! তাই তারাও মজা পায় না। আমারও গায়ে লাগে না।
সে তার মাথার উপরের গ্লাস ঘুরিয়ে দিল, যাতে পেছনে থাকা যাত্রীরা তাকে না দেখতে পায়।
আংকেলের মতে, চেহারা না দেখে গালি দিলে মজা না! তাই তারাও মজা পায় না। আমারও গায়ে লাগে না।
আমিও হাসছি।
আংকেলও।
আংকেলও।
আমাদের একদিন কারো মুখের সামনে গিয়ে গালি দিতে হবে।
আমরা টিভির সামনে বসে বসে তাদেরকে দেখে দেখে গালি দিই। আমরা তাদের মুখের সামনে গিয়ে গালি দিতে পারিনা বলে, হয়তো স্বস্তি পাইনা।
হয়তো আমাদের সরাসরি গালি দিতে দেখেনা বলে, তাদেরও শিক্ষা হয়না।
আমরা টিভির সামনে বসে বসে তাদেরকে দেখে দেখে গালি দিই। আমরা তাদের মুখের সামনে গিয়ে গালি দিতে পারিনা বলে, হয়তো স্বস্তি পাইনা।
হয়তো আমাদের সরাসরি গালি দিতে দেখেনা বলে, তাদেরও শিক্ষা হয়না।
আমাদের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল সত্যিকার অর্থে একটা আবুল মার্কা মাল, যার কাছে তিরিশ হাজার কোটি টাকা কোনো টাকাই না, আবার এক লক্ষ টাকার মালিক মজুররাও সম্পদশালী। সরকারদলীয় কয়েকজন চামচা ব্যতিত ( এরা সরকারের সবকিছুতে খুশি। কি জানি সরকারের পদ্মা সেতু ও হলমার্ক কেলেঙ্কারিতেও তারা খুশি কিনা) দেশের নব্বই ভাগ জনগণের আপত্তির বাজেটকে তিনি বলেন, এ বাজেট সর্বশ্রেষ্ট।
আমাদের অর্থমন্ত্রী সত্যিই একজন পাগল, শিক্ষামন্ত্রী নাহিদ যেমন। মাননীয় অর্থমন্ত্রী একদিন আসুন, দেখে যান এদেশের কত শত হত দরিদ্র মানুষ নুন্যতম মৌলিক অধিকারও পাচ্ছে না। সেখানে আপনার এসব বাগাডম্বরপূর্ণ দম্বোক্তি ও বড় বড় কথা কতটা জঘণ্য ও নিষ্টুর শোনায়।
মাননীয় মন্ত্রীর সমসাময়িক আরেকটি বিখ্যাত কুখ্যাত উক্তি, দেশে কোনো লোডশেডিং নেই। মাননীয় মান্য গণ্য জঘন্য মন্ত্রী, মহাখালির মত ভিআইপি এলাকাতেও যেখানে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুত সরবরাহ করতে পারেন না, সেখানে পল্লী আর উপশহরের অবস্থা কেমন সহজে আন্দাজ করতে পারছি। এসি রুমে বসে কখনো বুঝবেন না এখন মিথ্যা আস্ফালন মানুষের কতটা মনোবেদনার জন্ম দেয়। আমরা বাংলাদেশের মানুষ কখনো কোনো সময় নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুত পাই নি। তাই বিদ্যুত চলে গেলে আমাদের সাময়িক খারাপ লাগে। আবার আসলে খুশি হয়ে যাই। গলি থেকে গদির সব মানুষ চিল্লায়ে উঠে খুশিতে। আমরাও ভুলে যাই সব। ভাবি আমরা দরিদ্র দেশ। এটা আমাদের প্রাপ্য। কিন্তু আপনাদের এসব মিথ্যা উক্তি আমরা কিছুতেই নিতে পারি না।
দয়া করে এসব বন্ধ করুন। আমাদের এসব মিথ্যা স্বপ্ন দেখিয়ে লাভ নেই। জীবন বাঁচানো যেখানো দুষ্কর, ভাল থাকার চেষ্টা সেখানে কতটুকু ফলপ্রসু?
এতটা জঘন্য নিষ্টুর আপনারা হতে পারেন না....
এতটা জঘন্য নিষ্টুর আপনারা হতে পারেন না....
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন