প্রশ্নটা যতবার শুনেছি , মুচকি হেসে এড়িয়ে গেছি। কিছু গল্প আছে, যা বলার জন্য উপলক্ষ লাগে, একটা মানানসই পরিবেশ লাগে, বোনাস হিসেবে একটু আধটু উৎসাহ থাকলে মন্দ হয় না। এই গল্পটা ঠিক সেই রকম।
.
আমার লেখালিখির শুরু চিঠি লেখা থেকে। স্কুলে থাকতে এক জুনিয়র মেয়েকে কে প্রথম লিখেছিলাম। তাও একটা ছোট ভাইয়ের অনুরোধে তার গার্লফ্রেন্ডকে। তখন আমি ক্লাশ সেভেনে সম্ভবত। পরে আরো অনেকবার অনেক জনকে লিখে দিয়েছিলাম তার গার্লফ্রেন্ডকে দেবে বলে। ছোটবেলা বড় কোন দোষ বলতে এটাই। এছাড়া আমার আর কোনো দোষ কেউ দেখাতে পারবে না। আর এই ব্যাপারটাও জড়িতরা ছাড়া বাকি আর কেউ জানত না। তাই আমি পুরদস্তর ভালো ছেলেই ছিলাম সবার কাছে।
.
ক্লাশ এইটে শেষের দিকে এক বান্ধবীকে চিঠি লিখেছিলাম। হ্যাঁ, প্রেমপত্রই বটে। তবে ঠিক চিঠি নয়, পুরো একটা ডায়েরি। পুরোটাই আমার লেখা। আর লেখার মাঝে কিছু কবিতাও ছিল। কবিতাগুলো কি ছিল ঠিক ভুলে গেছি। তাকে কবিতাগুলো আমাকে একবার দেখাতে বলার ইচ্ছা। কিন্তু তাহলে সেটা ফেরত নেয়া হবে। তাই বলা হয় না। পরে আরো একবার চিঠি লিখেছি তাকে। ও হ্যাঁ, ডায়েরিই...
এভাবেই শুরু। বয়সের সাথে সাথে চিঠির লাইনের সংখ্যা বেড়েছে । কমেছে অক্ষরের আকার,এসেছে অনুভূতি , আবেগ আর বেগ ।
.
কৈশোরে কেবল তার জন্যই লিখেছিলাম প্রথম ভাললাগা। সে শুধু চিঠি ছিল না , চিঠির ভাঁজে কালচে খয়েরী শুকনো গোলাপ ছিল। লেখার ভেতরে স্বপ্ন ছিল, স্পর্শ ছিল, নির্দোষ চাওয়া পাওয়া ছিল, ছিল না শুধু যুক্তিতর্কের বালাই। এরপর যা হয় আর কি , // তুমি আর নেই সে তুমি তে// গল্পটা ফুরোল , নটে গাছটি মুরোল। চিঠিতে ভালবাসিও বলেছি, যদিও বয়স তখন মাত্রই পনের ছুঁইছুঁই। এটা যে খুব বেশি দোষের ছিল তা কেউ বলতে পারবে না। এখন তো দেখি মাত্র পাঁচ-ছয় বছরের ছেলে-মেয়েরাও প্রেমপত্র লিখে। হাইস্কুলে ওঠলেই ফেসবুক ইউজ করে।
যদিও সে ভালবাসা হারিয়েছে, আবেগগুলো আখেরে টেকে নি! তবে গোটা কয়েক চিঠি এখনো আছে। তাকে লেখা, দেওয়া হয়ে না ওঠা সেসব চিঠি।
.
কলেজে ওঠে আরেকজনকেও লিখেছিলাম একটা আস্ত ডায়েরি! তাকে খুব ভাল লাগত, এখনো লাগে। মাঝে-সাঝে তার কথা মনে পড়লে বাউন্ডুলটা নামিয়ে পড়ি। ও এখন কলেজে ওঠেছে। নতুন জীবন। অনেক ভাল থাকুক সে। তার সাথে আমার প্রেমটা ঠিক যায় না। আমাদের মধ্যে পারিবারিক একটা সম্পর্ক আছে। আমি চাই না আমাদের কারণে খারাপ কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি হোক। কলেজ লাইফ শুরুর প্রাক্কালে শহরে এসে অনেকদিন তার বাসাতেই ছিলাম। আলটিমেটলি অনেক স্মৃতি জমে আছে।
.
সত্যি বলতে, চিঠিগুলো কাব্য হয়েছে যখন নোনা জ্বল গড়িয়ে গাল, ঠোঁট ভিজেছে। লেখায় প্রাণ এসেছে হৃদয় ভাঙার পরে। ভালেবেসে আবেদনের পর তাকে উত্তর দেয়ার সুযোগটুকু দিই নি। জানি অনেক অভিমান তার, জমে আছে। আমি জানি একদিন সে সব ভুলে যাবে। ভুলে যাবে একদিন তার জীবন নদীতে আমিও বৈঠা বয়েছি কিছু মুহুর্তের জন্য।
সত্যি বলতে আমার লেখায় পরিপক্বতা এসেছে বই এর সাথে প্রেম হল যেদিন থেকে। নিষিদ্ধ, সমাজ অচ্ছুৎ বইয়েরা আমাকে ভাবিয়েছে , জানিয়েছে , চোখের ভ্রান্ত আবরণটা টেনে ছিঁড়ে আমাকে মানুষ বানিয়েছে। নিজের কাছে কৃতজ্ঞ বোধ করি অন্তত পা ভেঙে হাটঁতে শিখেছি। পিচ্ছিলে হাটার সাহস না করলে দৌড়াতে শিখতাম-ই না আর শেষমেশ তো ফড়িং হয়ে উড়েই বেড়াচ্ছি। আর একা উড়ছি তাও তো না , সমস্ত শুভস্মম আমার সাথেই আছে। অশুভ আমাকে স্পর্শ করার সাধ্য কই !
.
খেলাধুলার প্রতি ছোটবেলায় আগ্রহ ছিল আর দশটা ছেলের মত। কিন্তু আমি যখন খেলব, ঠিক তখন আমার বন্ধুরা অনেক দুর এগিয়ে গেছে। জুনিয়রদের সাথেও খেলতে ভালো লাগে না। বুঝে গেলাম খেলাধুলা আমার জন্য আসেনি। আমার আরো একজন সাথী ছিল। সাইদ মামা। সে খুব ভালো খেলত। বইমেলায় আমরা প্রচুর বই কিনতাম। তবে প্রথম দিকে পড়া বেশিরভাগ বই-ই সাইদ মামার ছিল। পরে বইয়ের মজাটাই পেয়ে গেল। স্কুল লাইব্রেরি থেকে বই চুরি করা শুরু। বিদেশি লেখকগুলোর সাথে পরিচয় সেখানেই। ব্যাগে যত পারি বই ভরে নিতাম কেউ না দেখে মত করে। সাংস্কৃতিক নানা ইভেন্টে অংশ নিতে আমরা উপজেলায় যেতাম স্কুল থেকে। সবাই জড়ো হতাম লাইব্রেরি। সেটাই ছিল বই চুরির শ্রেষ্ট সময়। পরে আমি চলে আসার পর ছোটভাই অনিক কেও টেকনিক শিখিয়ে দিলাম। এটা কোনো পাপ মনে হত না আমার কাছে সত্যি বলছি! কারণ বইগুলো আমার মনে হয় না আর কেউ পড়ে। অথচ অনেক দুষ্প্রাপ্য-বিখ্যাত বই সেখানে ছিল।
.
১১ মার্চ, ২০১৭
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন